আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-বাংলাদেশের বননীতি ও বিধিবিধান।যা “বাংলাদেশের বননীতি ও বিধিবিধান” এর অন্তর্ভুক্ত।
বাংলাদেশের বননীতি ও বিধিবিধান
প্রাগৈতিহাসিক যুগের ডায়নোসর -এর কথা সকলেরই জানা আছে। সেসব বিশাল আকৃতির সরীসৃপ প্রায় ১৪ কোটি বছর এই পৃথিবীতে রাজত্ব করেছিল। তারপর প্রাকৃতিক অবস্থার পরিবর্তন এবং জীবের স্বাভাবিক বিবর্তন ধারায় ক্রমে ক্রমে এই পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তাদের ফসিল বা জীবাশ্ম নিয়ে এখনো বিজ্ঞানীদের বিস্ময়ের শেষ নেই। এই সরীসৃপ। গোষ্ঠীর একটি প্রজাতি গুইসাপ, যেটি বর্তমান যুগেও পাওয়া যায়। এদের দৈহিক আকৃতিতে টিকটিকি এবং সাপ-উভয়েরই দৈহিক বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। বর্তমান যুগের গোখরো, চন্দ্রবোড়া সাপের আদিরূপ এই গুইসাপের মতোই ছিল।
একসময় বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গুইসাপ প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেতো। বর্তমানে সুন্দরবনে এবং কতিপয় বড় বনেই এদের অস্তির সীমাবদ্ধ। এই বিলুপ্তির প্রধান কারণ তাদের উজ্জ্বল মূল্যবান চামড়া। বাংলাদেশে গুইসাপ শিকারির সংখ্যা কম নয়। এখানে খোলা বাজারে বিক্রি হয় সাপ, কুমির, বনবিড়াল আর গুইসাপের চামড়া। বনাঞ্চলের বন্যপ্রাণীর জীবন এখন হুমকির সম্মুখীন।
প্রতিদিনই তাদের সংখ্যা কমছে। একসময় এ দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে চড়ে বেড়াতো নীলগাই। সিলেটে সোনালি বিড়াল, হাতি আর মোষ ছিল প্রচুর পরিমাণে। সেসব কবে হারিয়ে গেছে। স্বাদুজলের কুমিরও নেই। ময়ূর ও চিতাবাঘ বিলুপ্তির পথে। বহু মূল্যবান পাখি, লালনীর হাস আর কখনো দেখা যাবে না। চিত্রা হরিণ বিলুপ্তির পথে।
এই বিলুপ্তির জন্য প্রাকৃতিক নিয়মকে দায়ি করা যায়। তবে যে কারণটি এর জন্য বহুলাংশে দায়ি সে হলো শিকারির আদিম নেশা। কিছু সৌখিন শিকারি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন লঙ্ঘন করে বন্যপ্রাণী হত্যা করে চলেছে নির্বিচারে। এদের মধ্যে ব্যবসায়ীও আছে যারা হরিণ, সাপ, হাতি, বাঘ, কুমির, গুইসাপ ইত্যাদি হত্যা করে চলেছে ব্যবসায়িক স্বার্থে।
ওষুধ শিল্পে সাপের বিষ ব্যবহৃত হয়। আর চামড়ার বাজার তো সবসময়ই রমরমা। বন্যজন্তু হত্যা করে তাদের চামড়া দিয়ে ব্যবসায়ীরা যথেষ্ট মুনাফা করছে। তাছাড়া বাংলাদেশের জনসংখ্যা বাড়ছে। এই বর্ধিত জনসংখ্যার বসতি স্থাপন এবং চাষাবাদের সুবিধার্থে বন-জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করা হচ্ছে। মধুপুর, জামালপুর, সিলেটের ডাওকি, তামাবিলের বন-জঙ্গল করেই কেটে সাফ করে ফেলেছে। একমাত্র অবশিষ্ট দক্ষিণের সুন্দরবন। সেখানেও শিকারিদের দৌরাত্ম্যে বন্যপ্রাণীদের জীবন অস্থির হয়ে আছে।
এসব বন্যপ্রাণীর বিলুপ্তির কথা চিন্তা করেই সরকার বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন তৈরি করেছেন। এই আইনে বিশেষ কতগুলো প্রাণী হত্যার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। কিন্তু চোরা শিকারিরা অত্যন্ত বেপরোয়া। তাদের বন্দুকের আওয়াজে বনের নিস্তব্ধতা খান খান হয়ে ভেঙে পড়ছে।
বনাঞ্চলের এসব নিয়ম বহির্ভূত কার্যকলাপে বন্যপ্রাণীর স্বাভাবিক জীবনযাপন বিঘ্নিত হয় মারাত্মকভাবে। তাই বংশবৃদ্ধির স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেও তারা নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েছে। ফলে বাংলাদেশের সবুজ বনাঞ্চলের বন্যপ্রাণীদের প্রকম্পিত করে। তোলা আওয়াজ ক্রমেই ক্ষীণতর হচ্ছে। একদিন এই আওয়াজ থেমে গেলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না।
এসব চিন্তা থেকে বন সংরক্ষণ সম্পর্কিত বিষয় জনগণের বিশেষ করে সরকারের টনক নড়ে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের বননীতি ও বিধিবিধান প্রণীত হয়।বাংলাদেশের বননীতি প্রণীত হয় ১৯৭৯ সালে। ১৯৭৯ সালের বননীতি নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর সমাধান ও বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে প্রণীত হয়। বননীতির লক্ষ্যসমূহ হলো :
নম্বর ১/বন-১/৭৭/৩৪৫ দেশের আবহাওয়াগত ও ভৌত অবস্থা সংরক্ষণে বনাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা শনাক্ত করে এবং সুষম আর্থনীতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করে গাছপালা মাটির ক্ষয় রোধ করে, নদীর প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে, ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের বেগ প্রতিহত করে, দূষিত বায়ু ও জল বিশুদ্ধ করে এবং জীবমণ্ডলের প্রতিবেশে ভারসাম্য রক্ষা করে বিধায়।দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বনাঞ্চল কেবল মূল্যবান কাঠ ও জ্বালানি কাঠই উৎপাদন করে না, বনাঞ্চল মানুষের খানা, পশুর খাদ্য, ফল, তৈলবীজ, মশলা, তত্ত্ব, আঠা, ভেষজ দ্রব্যসামগ্রী ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস উৎপন্ন করে বিধায়।
ব্যাপকহারে বনায়ন, বনাঞ্চলের বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা কৌশল, বন্যজন্তু সংরক্ষণ ও বন্যজন্তুর জন্য অভয়ারণা স্থাপন ও পরিচালনের কথা বিবেচনা করে।এবং প্রত্যায়িত হয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন এ দেশে প্রাকৃতিক ভারসাম্য সংরক্ষণের স্বার্থে বনাঞ্চলের উন্নয়ন, পরিচালন ও সংরক্ষণের জন্য একটি প্রাকৃতিক নীতি গৃহীত হওয়া উচিত বিবেচনা করে:
সরকার সদয় হয়ে, নিম্নোক্ত জাতীয় বননীতি গ্রহণ করেছেন :
ক. গুণগত উন্নয়নের জন্য দেশের সকল বনাঞ্চলকে সতর্কভাবে সংরক্ষণ ও বৈজ্ঞানিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে:
খ. সরকারী বনাঞ্চলকে জাতীয় বনাঞ্চল হিসাবে অভিহিত করা হবে এবং এসব
বনাঞ্চলকে বনসৃজনের কাজেই ব্যবহার করা হবে :
গ. জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে গাছ লাগিয়ে বৃক্ষ ও কাঠ
সম্পদ বাড়ানো হবে এবং জাতীয় চাহিদা পূরণের জন্য পরিমিত বনজসম্পদ আহরণ করা হবে
ঘ. আধুনিক প্রবণতা ও প্রযুক্তির ভিত্তিতে বনসম্পদ ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে।
ঙ. বনসম্পদ নির্ভর শিল্প কারখানার জন্য জাতীয় বনাঞ্চল থেকে আবশ্যকীয় কাচামালের প্রয়োজন নিরূপণ করা হবে এবং নূতন নূতন বনজসম্পদ নির্ভর কলকারখানা স্থাপন করা হবে;
চ. বন সেক্টরের বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিক প্রশাসনিক চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে বনাঞ্চলের উপর গবেষণা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ছ. বন সেক্টরের জন্য গড়ে তোলা কর্মকর্তা ক্যাডারের সদস্যদের দ্বারা বন সেক্টরকে পরিচালনা করার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জ. জাতীয় বননীতি চালু করার উদ্দেশ্যে এই সম্পর্কিত আইনসমূহকে যুগোপযোগী করা হবে এবং বন সেক্টরকে সরকারের স্বতন্ত্র প্রশাসনিক ইউনিট হিসাবে গড়ে তোলা হবে।
ঝ. প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা ও বন্যজন্তু সংরক্ষণের এবং বনাঞ্চলের বিনোদন প্রদায়ক ভূমিকাকে ব্যবহারের জন্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গৃহীত হবে এবং এর বনাঞ্চল সম্বন্ধে উৎসাহ ও সচেতনতা সৃষ্টি করার লক্ষ্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাক্রমে ও গণমাধ্যমসমূহের মাধ্যমে ব্যাপক জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করা হবে এবং আগ্রহীদের প্রতি প্রযুক্তিক সহযোগিতা সম্প্রসারণ করা হবে।
আরও দেখুনঃ