পৃথিবীকে মানুষের বাসযোগ্য করে রাখায় বন ও বনাঞ্চলের ভূমিকা

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-পৃথিবীকে মানুষের বাসযোগ্য করে রাখায় বন ও বনাঞ্চলের ভূমিকা।যা বন ও বনাঞ্চলের অবদান এর অন্তর্ভুক্ত।

পৃথিবীকে মানুষের বাসযোগ্য করে রাখায় বন ও বনাঞ্চলের ভূমিকা

পৃথিবীকে মানুষের বাসযোগ্য করে রাখায় বন ও বনাঞ্চলের ভূমিকাই হলো প্রধান। পরিবেশের সকল ক্ষেত্রেই এটি মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। চিহ্নিত ক্ষেত্রগুলো হলো :

১.বায়ুমণ্ডলের আর্দ্রতা বৃদ্ধি ও তাপের সমতা রক্ষা
২.বন্যা ও প্লাবনরোধ
৩. ভূমির ক্ষয়রোধ;
৪. ভূমির উর্বরতা বৃদ্ধি ;
৫. ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসরোধ :
৬. বায়ু বিশুদ্ধকরণ ;
৭. শব্দদূষণরোধ ;
৮. মরুবিস্তাররোধ;
৯.ধুলোবালি ও দুর্গন্ধ দূরীকরণ;
১০. পশুপাখির আশ্রয় স্থল এবং
১১. জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ।

১। বায়ুমণ্ডলের আর্দ্রতা বৃদ্ধি ও তাপের সমতা রক্ষাঃ

 

পৃথিবীকে মানুষের বাসযোগ্য করে রাখায় বন ও বনাঞ্চলের ভূমিকা

 

বনের গাছপালার পাতা ও শাখা সূর্যরশ্মিকে মাটিতে পড়ায় বাধার সৃষ্টি করে। ফলে বনের মাটি নরম হয় না। ঠাণ্ডা মাটির সংস্পর্শে থাকা বনের ভিতরের বাতাস বাইরের বাতাস থেকে তুলনামূলকভাবে অধিকতর শীতল থাকে। এ কারণে গ্রীষ্মে বনের ভিতরে থাকা আরামের। বন যতো ঘন হয়, বনের ভিতরের তাপমাত্রা ততো কম হয়।

এ ছাড়া গাছ প্রস্বেদনের মাধ্যমে বাতাসে জলীয় বাষ্প ছড়িয়ে দেয়। ফলে বাতাসে আর্দ্রতা বৃদ্ধি পায় এবং বাতাসে তাপমাত্রা কমে আসে। গাছ মূলের সাহায্যে মাটির নিচ থেকে পানি টেনে নেয়। এই পানিই গাছ পাতার সাহায্যে বাতাসে ছাড়ে। গ্রীষ্মের কোনো গনগনে দুপুরে একটি বড়ো গাছ কম পক্ষে ১০০ গ্যালন পানি বাতাসকে উপহার দেয় এবং বাতাসের তাপমাত্রা কমানোয় প্রভূত সাহায্য করে। যা আধুনিক বিজ্ঞান আবিষ্কৃত দশটি এয়ারকুলারের পক্ষেও সম্ভব নয় ।

২।বন্যা ও প্লাবনরোধ

ঘন বন জঙ্গল পর্বতে, পাহাড়ে বা সমতলভূমিতে বৃষ্টির জলের স্রোতপ্রবাহ বা বরফগলা জলের স্রোতকে স্থানে স্থানে ঠেকায় এবং বিনা বাধায় যেতে দেয় না। এতে স্রোতের দোর্দণ্ড প্রতাপ বা গতিবেগ কমে আসে এবং বন্যা সৃষ্টি করতে পারে না। নদী, পুকুর, রাস্তা, বাঁধ, ঘরবাড়ির আশপাশে যদি ঘন গাছের বন সৃষ্টি করা যায় তাহলে বন্যার জল হঠাৎ করে নদী- নালা ছাপিয়ে প্লাবনের রূপ নিতে পারে না।

৩।ভূমির ক্ষয়রোধ

গাছপালার শিবন্ধু মাটিকে দৃঢ়ভাবে আটকে রাখে। গাছপালা বা ঘাসহীন মাটি বৃষ্টির জলে ধুয়ে যায়। মাটির ক্ষরণ সম্পর্কে এক গবেষণায় দেখা যায় সাধারণ ফসলী জমি থেকে একদিনে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ২২০০০ পাউন্ড, ঘাসে আবৃত জমি থেকে ১৮০০ পাউন্ড ও বনাঞ্চলে ৩৬০/- পাউন্ড মাটি ক্ষয়া হয়। পৃথিবী থেকে প্রতি বছর ৪ বিলিয়ন টন অজৈব, ৪০০ মিলিয়ন টন জৈবপদার্থ মাটির গা ধুয়ে সাগরে যায়। এমনি করে ১০ মিলিয়ন টন নাইট্রোজেন, ৩-৫ মিলিয়ন টন ফসফরাস ও ১০০ মিলিয়ন টন পটাশিয়াম প্রতি বছর মাটি থেকে সাগরে গিয়ে মিশে।

৪।ভূমির উর্বরতা বৃদ্ধি

 

পৃথিবীকে মানুষের বাসযোগ্য করে রাখায় বন ও বনাঞ্চলের ভূমিকা

 

গাছের পাতা, ডালপালা, বাকল, শিকড় ও বৃক্ষবাসী পশুপাখি ও কীটপতঙ্গের মলমূত্র ও দেহাবশেষ মাটির সঙ্গে মিশে খনিজ ও জৈবসারে পরিণত হয়। এই জৈবসারের নাম হিউমাস। মাটিতে নাইট্রোজেন, পটাশিয়াম ও ফসফরাস সরবরাহ করে। তদুপরি হিউমাস মাটির পানি ধারণের ক্ষমতা বাড়ায়।

মাটির কণাসমূহের বন্ধনকে শিথিল করে। এতে মাটি ঝুরঝুরে হয়। ঝুরঝুরে মাটির ফাঁপা শূন্য স্থানে অক্সিজেন থাকতে পারে। মাটির নিচের অসংখ্য ক্ষুদ্র প্রাণী এই অক্সিজেন সেবন করে প্রাণধারণ করে। মাটির নিচের প্রাণিকূল মাটির পরম হিতকারী। কারণ এরা মাটি ওলট-পালট করে উর্বরা শক্তিতে সমতা আনে।

তদুপরি প্রাণীদের দেহাবশেষ ও মলমূত্র জৈবসার হয়ে মাটির উর্বরতা শক্তি বাড়ায়। মাটি ক্ষয়ের দরুন মাটির বেশি ক্ষতি হয় উর্বরা শক্তির বিনষ্টিতে। এক সমীক্ষায় দেখা যায়, কোনো মাটির প্রায় সোয়া সেন্টিমিটার উর্বর মাটি পূরণ হতে ১০০ বছর সময় লাগে। উর্বরতা বৃদ্ধি ছাড়াও গাছগাছালির ঝরানো পাতা মাটির উপরে পুরু আস্তরণের সৃষ্টি করে। ফলে মাটি ঠাণ্ডা থাকে এবং এই আস্তরণ মাটি থেকে পানি উবে যেতে বাধা দেয়। এতেও মাটি পানি ধরে রাখার সুযোগ পায় ।

৫।ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসরোধ

ঘন বনাঞ্চল বা সারিবদ্ধ গাছের বেষ্টনী বাতাসের প্রবল বেগকে প্রশমিত করে। অবশ্য বনের গভীরতা, বনের সারিতে থাকা গাছের ঘনত্ব ও উচ্চতা এবং বিস্তৃতির উপর বাতাসের গতিবেগরোধের হার নির্ভর করে। দেখা যায়, গ্রামাঞ্চলের জনসাধারণ প্রতি মৌসুমী বায়ুতে সাধারণত যে দিক থেকে বেশি ঝড়ো বাতাস বয় সেদিকে উঁচু, ঘন, বিস্তৃত ও মজবুত গাছ রোপণ করে ও গাছ যাতে দ্রুত বাড়ে সেভাবে যত্ন নেয়।

এভাবে সর্বত্র পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা বন ও গাছের সারি বাতাসের গতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সুন্দরবন প্রায় সময় সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস ঠেকায়। সমুদ্রোপকূলে গড়ে তোলা বন-বেষ্টনী বর্তমানে সামুদ্রিক ঝড়কে কিছুটা ঠেকিয়ে রাখছে।

৬।বায়ু বিশুদ্ধকরণ

গাছপালা বায়ু থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনো-অক্সাইড ও ধুলোবালি অপসারণ করে এবং বাতাসকে পর্যাপ্ত পরিমাণ অক্সিজেন সরবরাহ করে। গাছ সালোক-সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার জন্য বাতাস থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস গ্রহণ করে। প্রক্রিয়া শেষে উপজাত হিসেবে সৃষ্ট অক্সিজেন বেরিয়ে আসে। গাছে প্রস্বেদন হলে সঙ্গতকারণে পাতার পৃষ্ঠদেশ ভিজা বা স্যাঁতসেঁতে থাকে। ভিজা পাতায় ধুলোবালি আটকা পড়ে। এভাবে গাছপালা বাতাসকে বিশুদ্ধ রাখে।

৭।শব্দদূষণরোধ

পরীক্ষায় জানা গেছে বনবনানী শব্দের প্রখরতা বা তীক্ষ্ণতারোধেও ভূমিকা নেয়। ৩২ মিটার গভীর বন ১০ ডেসিবল শব্দ কমাতে পারে। মানুষের কণ্ঠ-নিঃসৃত স্বাভাবিক শব্দ হলো ৪৮ ডেসিবল এবং চলন্ত রেলের শব্দ ১০০ ডেসিবল। গাছের ঘনত্ব, অবস্থান ও বিস্তৃতি শব্দের তীব্রতার হার নিয়ন্ত্রণ করে। হাইওয়ে, রেললাইন, মিল-ফ্যাক্টরি ও বাড়ির চারপাশে ঘন বনাঞ্চল থাকলে শব্দদূষণ থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে।

৮।মরুবিস্তাররোধ

মাটি গাছপালার আচ্ছাদনের নিচে না থাকলে সূর্যের কিরণ সরাসরি মাটিতে এসে পড়ে। এতে মাটির পানি বাষ্প হয়ে উড়ে যায়। মাটি শুকিয়ে ঝুরঝুরে হয়। এরকম দীর্ঘদিন চলতে থাকলে মাটির বেশ গভীর পর্যন্ত ফাপা হয়ে পড়ে। বৃষ্টিতে এই মাটি ভেসে যায়, বাতাসে তা উড়ে যায়।

মাটি ধীরে ধীরে উর্বরতা হারায়। এ মাটি তখন ঘাসের জন্য দেবার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলে। রুক্ষ বালির এই স্তুপ মরুসৃজন করে। এভাবে উত্তরবঙ্গে বৃক্ষহীন অঞ্চলসমূহে মরুময়তা দেখা দিয়েছে। আফ্রিকার সাহারা মরুভূমি এক সময় ঘন বনে আচ্ছাদিত ছিলো। মানুষ এই বন উজাড় করেছে। প্রতি বছর এই মরুভূমি ২-৩ বর্গমাইল বিস্তৃত হচ্ছে। ভারতের থর মরুভূমিও প্রতি বছর আধ মাইল করে বাড়ছে।

৯।ধুলোবালি ও দুর্গন্ধ দূরীকরণ

বাতাস বিশুদ্ধকরণ বিষয়ে আলোচনার সময় গাছের পাতার ধুলো ধরে রাখার কথা বলা হয়েছে। গবেষণায় জানা গেছে একটা বড়ো গাছ কেবল গ্রীষ্মেই ১০ পাউণ্ড ধূলি আটকিয়ে থাকে।

প্রতিটি গাছেই এক ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য তৈরি হয় এবং তা বাতাসে মিশে। কোনো কোনো গাছের রাসায়নিক দ্রব্য খুব সুগন্ধযুক্ত। নিম, ইউক্যালিপটাস, জাম, হরিতকি, জারুল, শিরিষ ইত্যাদি গাছের কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। গর্জন গাছের ক্ষীর থেকে ধূপ হয়।

তদুপরি নানান বৃক্ষে ফোটা ফুলের সুবাসও বাতাসের দুর্গন্ধনাশে বিরাট ভূমিকা পালন করে। অনেক সময় গাছ বাতাসের দুর্গন্ধ শুষে নেয়। এতে সেসব গাছের ক্ষতিও হয়। বিষাক্ত সালফার ডাই-অক্সাইড, ফ্লোরাইডস ও ওজন গ্যাস ইত্যাদিকে গাছ হজম করে মানুষকে রক্ষা করে, বাতাসকে বিশুদ্ধ করে এবং সেসঙ্গে অন্যান্য প্রাণীদেরও বাঁচায়।

 ১০।পশুপাখির আশ্রয়স্থল

প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার জন্য নানা জাতের পশুপাখি, কীট-পতঙ্গ প্রয়োজন। পশুপাখি, জন্তুজানোয়ার ও কীটপতঙ্গের প্রধান আশ্রয় হলো বনাঞ্চল ও গাছপালা। বনাঞ্চল ও গাছপালা ধ্বংস হয়ে গেলে এদের ধ্বংস অনিবার্য। ফলে প্রকৃতিতে দেখা দেয় নানান বিপর্যয়।

ঘন বনাঞ্চল ও যত্রতত্র গড়ে তোলা বনবনানী এই বিপর্যয় থেকে মানুষ ও পৃথিবীকে রক্ষা করতে পারে। UNDP ও FAO-এর এক জরিপে দেখা যায় শুধু সুন্দরবনে ৪ শত বাঘ, ১ লাখ ২০ হাজার হরিণ, ৪০ হাজার বানর ও ৪৩ হাজার জন্য শূকর রয়েছে। এ ছাড়া বনে ভালুক, সাপ, পাখি, কাঠবিড়ালি, গোসাপ ও কীটপতঙ্গ তো রয়েছেই।

১১।জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ

 

পৃথিবীকে মানুষের বাসযোগ্য করে রাখায় বন ও বনাঞ্চলের ভূমিকা

 

লক্ষ লক্ষ উদ্ভিদ ও প্রাণী, অণুজীব ও এদের দেহের জিনসমষ্টি এবং জটিল পরিবেশ জীববৈচিত্র্য গড়ে তুলে। মরুভূমি, রবফ অঞ্চল থেকে শুরু করে যে কোনো কঠিন পরিবেশেও জীবের অস্তিত্ব থাকে। তবে পৃথিবীর সর্বত্র জীবের অবস্থান সমান নয়। ফলে জীববৈচিত্র্য কোথাও কম, কোথাও বেশি।

পৃথিবীর শত ভাগের ১৪ ভাগ জুড়ে রয়েছে উষ্ণমণ্ডলীয় অরণ্য। এই চৌদ্দ ভাগেই পৃথিবীর উদ্ভিদ ও প্রাণী মিলিয়ে মোট জীবকুলের অর্ধেকের বেশি বাস করে। ক্রমে বনবনানী ধ্বংস হবার কারণে পৃথিবী থেকে বহু রকমের উদ্ভিদ ও প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন অনেক উদ্ভিদ ও প্রাণী বিলুপ্তির পথে।

বন-জঙ্গল এখানে সেখানে ধ্বংস হবার ফলে নির্দিষ্ট প্রজাতিসমূহের মধ্যে মিলিত হবার সুযোগ কমে যায় এবং পরবর্তীকালে ইপ্সিত প্রজন্ম সৃষ্টি দুষ্কর হয়ে পড়ে।

এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের প্রাণীর অস্তিত্ব না থাকলে খাদ্য শৃঙ্খল বিনষ্ট হয়ে যায়। এ কারণে জীবের বা প্রাণীর বিলুপ্তির আশংকা বৃদ্ধি পায়। কাজেই পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা ও প্রাণিকূলকে রক্ষার জন্যে বন ও বনাঞ্চল সংরক্ষণ এবং বনায়ন অতি জরুরি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment