পরিবেশে বন ও বনাঞ্চলের অবদান

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-পরিবেশে বন ও বনাঞ্চলের অবদান।যা বন ও বনাঞ্চলের অবদান এর অন্তর্ভুক্ত।

পরিবেশে বন ও বনাঞ্চলের অবদান

 

পরিবেশে বন ও বনাঞ্চলের অবদান

 

পরিবেশ বিজ্ঞানীরা জীবাশ্মঘটিত জ্বালানি তেল পুড়ে সৃষ্ট যে রাসায়নিক পদার্থ বায়ুমণ্ডলে অহরহ বিপত্তি ঘটাচ্ছে তা নিয়ে খুবই চিন্তিত। সে সঙ্গে কয়লা ও কাঠ পুড়ে সৃষ্ট ধোয়াও তাতে নবতর মাত্রা যোগ করছে। এসব বিষবাষ্প যে নীলকণ্ঠ শুষে নিতে৷ সেই বৃক্ষের নিধনও সমানে অব্যাহত রয়েছে এবং নিধনের তুলনায় বৃক্ষ সৃজনের উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে।

দুঃখজনকভাবে অনেক কম। জ্বালানি-সৃষ্ট (তেল, কয়লা বা কাঠ) কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডলের আদলে পরিবর্তন সাধন করছে। মহাকাশে তাপ ব্যাপনের দ্বারাই এই অনর্থ সৃষ্টি হচ্ছে। যাকে বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় গ্রীন হাউস অ্যাফেক্ট (Green house effect) বলা হচ্ছে। কার্বন-ডাই-অক্সাইডের ক্ষতিকর প্রভাব রোধ করতে পারে একমাত্র শ্যামলী নিসর্গ। গাছপালা এই বিষকে অমৃতে পরিণত করে।

অর্থাৎ বৃক্ষ কার্বন ডাই-অক্সাইডকে কাজে লাগিয়ে এর জন্য অপরিহার্য শ্বেতসারজাতীয় খাদ্য প্রস্তুত করে। এই প্রক্রিয়ার নাম ফটোসিন্থেসিস বা সালোক-সংশ্লেষণ। গাছপালার বিনাশসাধনের ফলে বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ছে। সে সঙ্গে বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। সালোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় গাছ প্রচুর পরিমাণ অক্সিজেন তৈরি করে তা বাতাসকে উপহার দেয়।

যদি ইকোসিস্টেম অর্থাৎ গাছ-পালা ও জীবজন্তু এবং তাদের চারপাশের পরিবেশের মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকে তাহলে জলবায়ু সুস্থিত থাকে, মাটির স্বাস্থ্য অক্ষুণ্ণ থাকে, জলসরবরাহ নিয়মিত থাকে, বাতাস বিশুদ্ধ থাকে ও শব্দদূষণ কম থাকে। এ ছাড়া শ্যামলী নিসর্গের নান্দনিক ও বিনোদনমূলক ভূমিকাও তো অনস্বীকার্য।

একটি বন ও তার পরিবেশের মধ্যে সর্বক্ষণিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া থাকে। অতি আবশ্যকীয় পারিবেশিক বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে মাইক্রো-ক্লাইমেট (Micro-climate) মাটির বৈশিষ্ট্যসমূহ, আর্দ্রতা বজায় থাকায় নিশ্চয়তা ও জীবজন্তু ও পতঙ্গকূলের পারস্পরিক ক্রিয়াকাণ্ডের বিদ্যমানতা ইত্যাদি। সৌর বিকিরণ, বৃষ্টিপাত, বায়ুপ্রবাহ, আর্দ্রতা, বায়ুমণ্ডলের তাপ ও মাটি মাইক্রো-ক্লাইমেটকে নিয়ন্ত্রণ করে।

একটি ঘন বনে তাপমাত্রার পরিসর হয়। ক্ষীণ যদিও বনের বাইরের ও ভিতরের বায়ুর তাপমাত্রায় কমবেশি সমতা বজায় থাকে। তবে বনের ভিতরে আর্দ্রতার পরিমাণ থাকে বেশি। বন মাটির তাপমাত্রাকেও প্রভাবিত করে। এই তাপমাত্রা মাটির উপরের স্তরের জৈবনিক কর্মকাণ্ডেও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। বন বায়ুর গতিবেগকে প্রতিহত করে।

এ কারণে নদী বা সাগরের উপকূলে গাছের বেষ্টনী গড়ে তোলা হয়, অথবা ঝঞ্ঝা-সংকুল স্থানে পরিকল্পিতভাবে বৃক্ষ বেষ্টনী সৃজন করা হয় যাতে বাতাসের রুদ্ররোষকে প্রশমিত করা যায়। এভাবে সে এলাকার শস্য উৎপাদন নির্বিঘ্ন করে তোলা হয়। গাছপালা ও তৃণের আচ্ছাদনহীন বিরান মাটি সহজেই বাতাসের তোড়ে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।

ব্যাপক বিরান ভূখণ্ডে বনাঞ্চল সৃজিত হলে সে অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেড়ে যায় এমন কোনো প্রমাণ নেই। তবে এটি একশবার সত্য যে, বনে বা বনাঞ্চলের বাইরে চারপাশের তাপমাত্রায় একটা সমতা অবস্থা সবসময় বিরাজ করে। ব্যাপক বিস্তৃত বনাঞ্চল অবশ্য বনাঞ্চলের উপরে কিছুটা মেঘ সৃষ্টি করতে পারে এবং বৃষ্টিপাত কিছু বেশি ঘটানোয় ভূমিকা রাখতে পারে। বৃষ্টি গাছের চূড়ায় পড়ে। ফলে প্রথমে এর পতন বেগের গতি রুদ্ধ হয়।

 

পরিবেশে বন ও বনাঞ্চলের অবদান

 

গাছের উপরের দিকের পাতা ও শাখা ভিজে। কিছু কিছু বৃষ্টির পানি উবেও যায়। কিছু পরিমাণ পানি গাছের গুঁড়ি বেয়ে বনাঞ্চলের মাটিতে নেমে আসে। পাতা ও শাখার ফাঁক গলিয়ে কিছু বৃষ্টির ফোঁটা সরাসরি মাটিতেও এসে পড়ে। যদি পুরো বনাঞ্চল ঘনভাবে সৃষ্ট গাছে ছেয়ে থাকে তাহলে বৃষ্টি সরাসরি বনের মাটিকে আঘাত করতে পারে না।

এ ছাড়া বড় গাছের নিচে যদি গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ ও আগাছায় ঠাসা থাকে তাহলে বৃষ্টি প্রায় একেবারেই সরাসরি মাটিতে পড়তে পারে না। বনের মাটির উপরিভাগে পাতা পচে যদি হিউমাস বা জৈবসারের স্তর গঠিত হয়, তবে বৃষ্টির পানি ধীরে ধীরে চুঁইয়ে চুইয়ে মাটির উপস্তরে পৌঁছায়।

এই পানি অনুসাবিত বা ফিল্টারকৃত হয়ে মাটির আরো গভীরে যায়। বর্ষা ঋতু ছাড়া অন্য ঋতুতে নদী সারা বছর এই পানির সরবরাহ পেয়ে থাকে। মাটি পানি দিয়ে সম্পৃক্ত হবার পর, অতিরিক্ত পানি প্রবাহিত হতে থাকে। তবে এই প্রবাহ চলে মন্থর গতিতে। কারণ তৃণ, বীরুৎ ও পাতার আবর্জনা জল-প্রবাহে বাধার সৃষ্টি করে। ফলে বালির বড় কণারাও প্রবাহের তোড়ে ভেসে যাওয়া থেকে রক্ষা পায়।

যখন কোনো ভূখণ্ডে বৃক্ষের চাঁদোয়া থাকে না, তখন বনাঞ্চলের মাটিতে জৈবসার কম থাকে। তখন বৃষ্টির ফোঁটা সরাসরি মাটিতে আঘাত হানে এবং ভূমি ক্ষয় ঘটায়। ফলে মরুবিস্তার ঘটতে থাকে। পর্যায়ক্রমে শুকনো ও ভেজা মৌসুম চলতে থাকলে, পর্বতের বা ভূখণ্ডের ঢালু অঞ্চল মাটি ক্ষয়ে ক্ষয়ে আরো খাড়া হতে থাকে। তদুপরি এখানে অধিক পশু চড়ানো হলো ঘাসের পরিমাণ কমে যায়, সে সঙ্গে জুম চাষের জন্য অগ্নিকাণ্ড ঘটানোর উপসর্গ তো আছেই। এভাবে সংকীর্ণ উপত্যকা বা সমতলে খাঁড়ির সৃষ্টি হয়।

বৃক্ষের মূল শিলাবৎ কঠিন মাটির গভীরে প্রবেশ করে এবং মাটিকে আঁটসাঁট বাঁধনে ধরে রাখে। যখন মূল মরে যায় তখন মূলগুলো কৈশিক নালির ভূমিকা নেয় এবং পানিকে মাটির গভীর স্তরে যেতে সাহায্য করে। যখন বনাঞ্চলের বৃক্ষরাজি ধ্বংস হয়, তখন মাটির উপরিস্তরের পাতার স্তর ও জৈবসার পানির তোড়ে ভেসে যায় এবং মাটি অরক্ষিত হয়ে পড়ে। বর্ষাকালে মাটির রন্ধসমূহ পানিতে ভরে যায় এবং পানি চুঁইয়ে নামতে থাকে।

কিন্তু চোয়ানোর পরিমাণ হয় নগণ্য। ফলে বিপুল পানির স্রোতে মাটি তো ভেসে যায়ই, সঙ্গে নুড়ি পাথর ও এমনকি বোল্ডারও ভেসে যায়। এতে মাটির নিচের শিলা বেরিয়ে পড়ে। বর্তমানে চট্টগ্রাম, সিলেটের বহু পার্বত্য এলাকায় এই দৃশ্য স্পষ্ট চোখে পড়ে।

অপ্রতিহত পানির প্রবাহ নদীতে অকস্মাৎ বান ডাকে। নদীতে জলস্ফীতি ঘটে। সমতলে ভারি মাটিবাহিত জলস্রোতের কারণে নদীর দিক পরিবর্তনের আশংকা থাকে। এ রকমটি ঘটলে জনপদ বিনষ্ট হয়। শস্যহানি ঘটে। বনাঞ্চল ধ্বংস হবার জন্যে এ ধরনের খেসারত আমাদেরকে ফি বছরই দিয়ে যেতে হচ্ছে।

 

পরিবেশে বন ও বনাঞ্চলের অবদান

 

বিদ্যুৎ বা শক্তি উৎপাদনের জন্য অথবা সেচের জন্য নদীতে বাঁধ দিলে এবং উজানে জলপ্রবাহে প্রচুর পলি বাহিত হলে, নদীতে তলানি জমে নদীর জলধারণের ক্ষমতা সীমিত হয়ে যায় এবং নদী ক্রমে গুরুত্ব হারাতে থাকে।
বনাঞ্চল প্রচুর পরিমাণ জল শোষণ করে। বৃক্ষের মূল জল পরিশোষণ করে এবং তা কোষে অভিস্রবণের মাধ্যমে পাতায় প্রেরণ করে। পাতা থেকে বাষ্পমোচন হয়। গাছের পাতায় পড়া বৃষ্টির ফোঁটাও বাষ্পীভূত হয়ে যায়। ফলে বাতাস বিশুদ্ধ হয়।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment